Parna’s Paraphernalia

স্মৃতির তরণী

পরীক্ষায় বাংলার ইতিহাস


আমি তখন ক্লাস নাইন এ পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। সেই সময়ে দুটো বিষয়ের পরীক্ষা একই দিনে নেওয়া হত। এখনো সেই প্রচলন আছে কিনা জানিনা। একদিন সন্ধেবেলায় বই খুলে পড়ছি। পরের দিন ইতিহাস ও বাংলা রচনা ও ব্যাকরণ (বাংলা ফার্স্ট পেপার) পরীক্ষা। মোট দুশো নম্বর। খানিক্ষণ ইতিহাস পড়ার পর মনে হল, আর পড়ে বিশেষ লাভ নেই, এমনিও বানাতে হবে অমনিও বানাতে হবে। নিজেকে পুরাকালের ইতিহাস রচয়িতা মনে করে আপন মনে মাধুরী মিশিয়ে লিখে যেতে হবে পাতার পর পাতা। হঠাৎ মনে হল বাংলায় তো সবই আনসিন আসবে, পড়ে কোন লাভ নেই, তার চেয়ে বরং আনন্দমেলার সংকলন গুলো নিয়ে বসি। গল্পও পড়া হবে আবার রচনা লেখার জন্য কিছু নতুন শব্দভাণ্ডারও তৈরি থাকবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আনন্দমেলার উপন্যাস গুলো পড়তে শুরু করে দিলাম। দাদা পাশে বসে ছিল। ওকে বলতে হল না, নিজেই বলল মা এলে সতর্ক করে দেবে। মা কে আমরা খুবই ভয় পেতাম, এবং তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল হিটলার। সেই বিশেষ নামটি কেবল আমরা ও বাবা জানতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। অবাক করে দিয়ে বাবা হাজির হলেন। আমরা পড়াশুনো করবার সময় বাবা খুব একটা আসতেন না। আমাদের প্রতি ওঁর অটুট বিশ্বাস ছিল। দাদা আমাকে সতর্ক করার সুযোগই পেল না। অতর্কিতে আক্রমণ করার ভঙ্গিতে বাবা বললেন,” তা তোর না কাল ইতিহাস পরীক্ষা? পড়া তৈরি? আনন্দমেলা পড়ছিস যে” আমি বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে বলেছিলাম, “বাবা, ইতিহাস তো এখান থেকেই তৈরি হয়।” বলে আবার সেই উপন্যাসে মনোনিবেশ করলাম। বাবা হাসি চেপেছিলেন না রেগে গিয়েছিলেন, তা আর মনে নেই। তবে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে (ব্যঙ্গ মিশ্রিত কৌতুক ও কপট রাগ। বাবাকে যাঁরা চেনেন তাঁরা আশাকরি ভাল বুঝতে পারবেন) বলে উঠলেন, “হুমম। তা তো অবশ্যই। তা সেই ইতিহাস লিখে পাশ করবে তো লোকজন? না হলে কিন্তু হিটলার ইতিহাস ফেল রহস্য উদঘাটন করে ফেলবেন। এবং তারপর কি হবে আমি জানিনা।” নাহ। হিটলার আর তলব করেননি। সে যাত্রায় মায়ের হাতের মার থেকে খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম।

ভয়ালহরি অঙ্কনাথ

অঙ্কে বেজায় কাঁচা ছিলাম ছোটবেলায়। অঙ্ক মানেই মনে হত বিপদ আসছে সব প্রহরণ সাথে করে। এমনই এক যাকে ইংরেজীতে বলে ‘আইরনি’ যেটা ছিল সেটা হল আমার মা একটি স্কুলের মাধ্যমিক বিভাগের অঙ্কের শিক্ষিকা ছিলেন। তাবড় তাবর ফেল করা ছাত্রীদের উনি বকে ঝকে শিখিয়ে পড়িয়ে খাটিয়ে পাশ করাতেন বলে শোনা যেত। কিন্তু বাধ সাধলাম আমি। কোনভাবেই আর উনি আমায় পাশ করাতে পারতেন না। নৌকো ৪০এর তীরে ভেরার আগেই ৩৫ অথবা ৩৭ অথবা ৩৮এ আটকে যেতো ও ডুবে যেতো। অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আমার জন্য অঙ্কের গৃহশিক্ষক রাখা হবে। তখন আমি কায়ক্লেশে সাঁতরে সাঁতরে সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছি। অঙ্কের আবার দুটো পেপার। মানে বিপদ দ্বিগুন।
সেই মাষ্টারমশাই ছিলেন একেবারে আগ্নেয়গিরি। একটু ভুলচুক করলেই খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। মারতেন না কিন্তু চোখা চোখা বাক্যবাণেই ঘায়েল করে ফেলতেন। ফলস্বরূপ আমাকে দেখা যেত উনি পড়িয়ে চলে যাবার পর প্রায়ই কাঁদছি। একদিন হল কি, – আমার শিক্ষক আমাকে বৃত্তের পরিমিতি ও ক্ষেত্রফল খুব ভালভাবে বোঝানোর পরে কিছু বাঘা বাঘা অঙ্ক দিয়েছেন। অপেক্ষাকৃত সরল অঙ্কগুলো কোনভাবে ঢোক টোক গিলে উত্‌রে গেছে। এবারে এল একটি জল্লাদ। বৃত্তের সাথে সিলিন্ডার যোগ করে কিছু একটা ভজঘট হয়েছে। এবং তাদের ক্ষেত্রফল ও পরিমিতির সমাধান করে তাদের কে ধন্য করতে হবে। অঙ্কটা পড়া মাত্র আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। খাতায় কোন বিশ্বাসজনক আঁকিবুকি কাটতে পারলাম না। ভদ্রলোক তাঁর বাক্যবাণ বর্ষণ করে খাতা ছুঁড়ে চলে গেলেন। দোষ আমারই ছিল। উনি বারবার বলা সত্ত্বেও আমি ওঁকে বলতে পারিনি যে আমার বুঝতে অসুবিধে হয়েছে এবং আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
উনি চলে যাবার পর যখন ভাবছি খানিকটা হাপুশ নয়নে কেঁদে হাল্কা হব কিনা, মা ডাকলেন। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দেখলাম মা রুটি করতে করতে খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখছেন। মায়ের হাতে রুটির বেলুন দেখে আর সন্দেহ রইল না। এবারে পিঠে খানকতক ঘা পড়ল বলে। পরনের জামাটার দিকে চোখ চলে গেল। নাহ। জামাটাও পাতলা। বাঁচাতে পারবে না। যখন এসব সাত পাঁচ ভাবছি, মা রুটি বেলতে বেলতে খুব সহজ ভাবে বললেন রুটির আকার কে লক্ষ্য করতে। তারপর খুব সাবলীল ভাবে বুঝিয়ে দিলেন বৃত্তের ক্ষেত্রফল ও পরিমিতি। পাশে রাখা গ্যাস সিলিন্ডারটা দেখিয়ে ওই ভজঘট জল্লাদ অঙ্কটাও বুঝিয়ে দিলেন। তারপর আমি ৫ মিনিটে অঙ্কটা সমাধান করে ফেলি। চোখের জল পরিণত হল মুখের হাসিতে। মা সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলেছিলেন, “কাঁদবি না। কাঁদা খুব সহজ, হাসা খুব কঠিন।” তাই হয়ত মা যেদিন চলে গেছিলেন, কাঁদতে পারিনি।

মুরগী কাকুর বাগান

তাঁর নামটি ছিল আর এস মুখার্জী। নামের আগে একটি উপাধি ছিল। ডাক্তার। অথচ ওঁরই কিনা নাম হয়ে গেল মুরগী মুখার্জী! আমরা যারা একই পাড়ায় থাকতাম, তারা ছাড়াও অন্য পাড়ার অধিবাসীরা তাঁকে চিনতেন এই জনপ্রিয় নামটিতে। এরকম অদ্ভুত নামকরণ কে বা কারা করেছিল জানা নেই তবে নামের নেপথ্যে ছিল ওঁর বাগানে চাষ করা মুরগীরা। কোন এক রাতদুপুরে মুখার্জী কাকুর বাড়িতে চোরেরা অথবা কিছু উঠতি চ্যাংড়া ছেলেপুলে বাগান থেকে মুরগী চুরি করে রান্না করে এবং পরের দিন ভোরবেলায় এই কাণ্ড দেখে উনি যারপরনাই বিলাপ করতে থাকেন। সেই থেকে ওঁর নামে মুরগী জুড়ে গেছিল। এই অবধি পড়ে যাঁরা ভাবছেন যে ছেলেগুলো তো বড়ই উচ্ছৃঙ্খল, এরকম একটা ক্ষতি করল, তাঁদের বলব একটু ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়তে।
তা, এই উঠতি যুবকবৃন্দের দোষ বিশেষ ছিল না। কাকু কাউকেই নিজের বাগানের ধারেপাশে ঘেঁশতে দিতেন না। বাগানের বাতাবি লেবুর গাছ, ফুল গাছ, সজনে গাছ দের কে সযত্নে লালন পালন করতেন এবং জীবন্ত যক হয়ে আগলে রাখতেন। পাড়ার কেউই সেই ফলনের ভাগ পেতাম না। পাড়ার ছেলেরা ক্রিকেট বা ফুটবলের বল ওনার বাগানে পড়ে গেলে যদিও বা ভাবত যে লেবুটা বা আমটা বা পেয়ারাটা জামার ভিতরে চালান করবে, তা ভাবনার স্তরেই থেকে যেত, কখনও সখনও বলগুলোও থেকে যেত গাছেদের সাথে। একেবারে বইয়ের পাতার সেই সেলফিশ জায়ান্ট। আমগাছের কথা বলিনি এখনও, না? আমার মা বলতেন, মুরগী কাকু, কায়দা করে আমাদের বাগানের একেবারে ধারের দিকের আমগাছটি আপন করে নিয়েছিলেন, বেড়ার এদিক ওদিক করে। হ্যাঁ উনি আমাদের ঠিক পাশের কোয়ার্টারেই থাকতেন। আমাদের বাগানে আরও তিনটি আমগাছ ছিল এবং এই চারটে গাছই আমার ঠাকুরদার হাতে লাগানো গাছ ছিল। আমের সময়ে, মনে পড়ে আমাদের পুরো পাড়ার সবাই আমাদের গাছের আম খেতেন। ঝড়ের সময় অনেকেই চলে আসতেন আম কুড়োতে। আবার অনেকে ঝড়ের পরে দরজা খুলে অপেক্ষা করতেন আমি বা দাদা আম নিয়ে যাব বলে। মুরগী কাকু অবশ্যই আমাদের আমের ভাগ দিতেন না আর আমরাও ওঁর বাড়ি আম নিয়ে যেতাম না।
একবার ওঁর বাগানের আম গাছটিতে অনেক বোল ধরেছিল। উনি তখন ঝাঁটা ও পুরোনো বুট জুতো গাছে ঝুলিয়ে দেন, সম্ভবত নজর না লাগার পাকা ব্যবস্থা করেছিলেন। সেবছর হল কি, বেশ অনেক্ষণ ধরে কালবৈশাখীর ঝড় চলল। আমি, মা ও দাদা ঝড়ের মধ্যেই টপাটপ আম কুড়োচ্ছি এবং খালি ব্যাগ বস্তা যা পাচ্ছি তার মধ্যে জমিয়ে রাখছি, এমন সময় দেখি হাওয়ার তোড়ে, কাকুর গাছের ঝাঁটা-জুতো সুদ্ধু আমেরা আমাদের বাগানে এসে দেহ রাখছে। আনন্দের সীমা রইল না। চাল রাখার খালি বস্তা নিয়ে এসে আমি ও দাদা দ্বিগুন উৎসাহে আম কুড়োতে শুরু করলাম। ঝড় থামার সময়ে কাকু ব্যাগ ও বস্তা নিয়ে হতোদ্যম হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ সুরেলা গলায় আমাকে ডেকে অনুরোধ করতে লাগলেন কয়েকটা আম ওনাকে দিতে। আমরা তো কিছুতেই কোন অনুরোধে কান দেব না ঠিকই করে রেখে ছিলাম। একে টেক্নিকালি আমাদের ঠাকুরদার লাগানো গাছ তার ওপর আবার প্রচুর ফলন। হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে উঠেছিলাম দুই ভাইবোনে। মা আমাদের চোখে চোখে অনুরোধও করলেন, কিন্তু আমরা পাত্তা দিলাম না মোটেই। বাবা পুরো ঘটনাটাই জানালা দিয়ে চুপি চুপি লক্ষ্য করেছিলেন। এহেন বিপ্লবীদের দমন করা প্রয়োজন মনে করে সেবার বাবা আমাদের তীব্র ভর্ৎসনা করে নিজে গিয়ে ওনাকে কিছু আম দিয়ে এসেছিলেন।
এই ঘটনার পর মুরগী কাকু একটু যেন বদলে যান। ডেকে ডেকে সজনে ডাঁটা দিতেন, বাতাবী লেবু বা এঁচর দিতেন। হেসে কথা বলতেন। আমরা ওই কোয়ার্টার ছেড়ে দেওয়ার দিন পর্য্যন্ত এই সৌজন্যবোধ বজায় ছিল। এর বেশ কিছু বছর পরে শুনলাম কাকু মারা গেছেন। মনটা বিষাদে ভরে উঠেছিল। মনে হয়েছিল একটুকরো বর্ণময় ছোটবেলাটা যেন কোথায় ভিনদেশে মুরগীকাকুর সাথে পাড়ি দিয়ে দিয়েছে।

মাতৃপরশ

বয়স তখন চার পেরিয়েছে কি পেরোয়নি। একদিন সকালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার এর ‘হাসিখুশি’ পড়ছি, হঠাৎ মা এসে আমাকে ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকাটি হাতে দিয়ে বললেন “পড় দেখি। পড়তে অসুবিধে হলে বলিস।” আমার মনে তখন যুদ্ধজয়ের আনন্দ। মনে হচ্ছিল যেন আচমকা বড় হয়ে গেলাম। মনে হওয়ার কারণ ও ছিল। ‘আনন্দমেলা’ বাড়িতে এলেই প্রথমে দাদা পড়ত, তারপর মা ও বাবা, আর আমি শুধু প্রচ্ছদ এর ছবি দেখতাম পড়তে পারতাম না বলে। স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ পরিচয় সম্পুর্ণ হতেই ‘হাসিখুসি’ ও ‘আনন্দমেলা’ য় উত্তরণ যখন ঘটল তখনও কিন্তু আমি যুক্তাক্ষর পড়তে পারি না, যেখানে আটকায়, বাবা, মা বা দাদা কে দেখিয়ে নি। গল্প পড়ার আকর্ষণে তখন কোন বাধাই বাধা নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনো শুরু করি। সব বই ইংরেজি তে লেখা। মন টা হাঁফিয়ে উঠত। বাংলা বিষয়ের পাঠ্যবই টা নিয়ে পড়ে যেতাম টানা। বাড়িতে ইংরেজি বলা নিষিদ্ধ ছিল মায়ের আদেশে। বাবা যদিও বা নিজে ইংরেজি বই পড়তেন, আমাদের খুব একটা উৎসাহ দিতেন না ইংরেজি পড়তে, বলতেন, “সেই ত পড়বি ই, বাংলা গল্পের বই গুলো আরো মজার।” ক্রমে বড় হলাম। বাংলার শিশুসাহিত্য ও কিশোরসাহিত্যের সব বই ই মোটামুটি পড়া হয়ে গেছে এরকম অবস্থায় পড়তে শুরু করলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘দূর্গেশনন্দিনী’। সত্যি বলতে কি, কোন রসাস্বাদন করতে পারলাম না। হয়ত, আমার ই বিফলতা। ফিরে গেলাম রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে, নাটকে, ও উপন্যাসে। পড়লাম আরও অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টি। ইংরেজি গল্পের বইও হাতে এল, পড়লাম। পড়তে পড়তে বুঝলাম কেন এতদিন ইংরেজি বই আমাদের কাছে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল। আমাদের অভিভাবকরা ভেবেছিলেন যে আমাদের সাহিত্যানুরাগী করে তুলতে গেলে মাতৃভাষাকে সম্মান করতে শেখাতে হবে। নিজের ভাষাকে ভাল না বাসলে অন্য ভাষাকে ভালবাসা যায় না। বলা বাহুল্য, তাঁরা তাঁদের ভাবনায় সঠিক ছিলেন।
ইদানিং, আমি ইংরেজিতে লিখি। ইংরেজি তে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিন্তু বাংলা না জানলে আমি ইংরেজিকেও ভালবাসতে পারতাম না। তবে আজও, বাংলা ও ইংরেজি তে লেখা পাশাপাশি দুটো বই থাকলে বেছে নি বাংলায় লেখা বইটিই। বাংলা ভাষায় লেখা গল্প, উপন্যাস ও রম্যরচনায় পাই মাতৃস্নেহের পরশ।

স্মৃতির বাগান

দূর্গাপুরের এম এ এম সি টাউনশিপের অন্তর্গত বি-ওয়ান ১০৭/২ কোয়ার্টারের ছড়ানো বাগানে তখন অবাধ বিচরণ করা যেত। আম, কাঁঠাল, পেঁপে, পেয়ারার গাছেরা ছিল বন্ধু গাছ। শত্রু গাছ ও ছিল, – বাসক পাতার গাছ – ঘনঘন ঠাণ্ডা লাগার কারণে গিলতে হত তেতো পাঁচন। উপরোনোর চেষ্টা চলেছিল পুরোদমে – কিন্তু ছোট ছোট হাতের জোর কে সে অবজ্ঞা করে বেড়ে চলছিল।শীতকালে কিছু মরশুমি ফুলের দল আসত পরিযায়ী পাখিদের মত। আর পাখী – নাঃ শালিখ ছাড়া আর কিছু মন দিয়ে খোঁজা হয়নি তখন।

একদিন সেই বাগানে এক অশীতিপর বৃদ্ধ মালী – সন্তোষ কাকুর আবির্ভাব হল। বাগানটাই বেবাক বদলে গেল। সজনে গাছের ওই পারে আলু, পালং শাক, মেথি শাক বোনা শুরু হল, বেগুন, টমেটো ও কাঁচালঙ্কাও লাগানো হল। কিন্তু সেই ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে ভয় করত – কি জানি কোন শাকটার ব্যাথা লেগে যায়। বাগান টা ছিল সন্তোষ কাকুর প্রাণ। সারাদিন খাটতে পারতেন আর বেলা পড়ে এলে দিতেন গাছের সারের হদিশ। বাবা মা যখন ওঁর সাথে একসাথে চা খেতে খেতে ওঁর সাথে গাছ নিয়ে আড্ডা মারতেন আর সময় পেলেই ওঁর সাথে গাছের পরিচর্যা করতে লেগে যেতেন, খুব মজা হত – শ্রেণীসমতার সেই প্রথম পাঠ – হাতেকলমে। …

বাবা মায়ের ষ্টীলের চায়ের কাপের ধূমায়িত চায়ের কোন ভাগ ছিল না, ভাগ ছিল টায়ের চানাচুর ও মুড়িমাখায়। আর, আর ভাগ ছিল গল্পের, আলোচনায়। অধিকার ছিল মতামত দেওয়ার ও শোনার। আধ ঘণ্টার চা পানে হঠাৎ বড় হয়ে যাবার একটা আকর্ষন।

চা পানেরও অধিকার যখন পাওয়া গেল, তখন বদলে গেল বাসস্থান। আরেকটা কোয়ার্টার, – সি ডি ১১১/১। মা চেয়েছিল বাগান করার বিস্তর যায়গা আর আলো হাওয়ার অবাধ যাতায়াত, তাই বাছা হল এই কোয়ার্টার। তাও পুরোনো কোয়ার্টারের মায়া কাটানো গেল না। নতুন বাসস্থানের বাগানে ছিল কাঁকর, বালি ও সিমেন্টের অবশেষ। কেউ বা কারা যেন বেছে বেছে এই যায়গাটাতেই সিমেণ্টের মশলা তৈরি করত, তারা আসার আগে। অশীতিপর সন্তোষ কাকু তখন নবতিপর। হাতের জোর কমে গেলেও মনে কঠিন সঙ্কল্প, – বাগানটিকে আবার মনের মত করে তুলবেন। মনের মত বাগানে যখন ফুল ও সবজি ফলতে শুরু করলো, তিনি বাগানের মায়া কাটিয়ে পাড়ি দিলেন না ফেরার দেশে।

আরও আরও পরে সেই বাগান আর বাগান থাকে না। অনেককাল পরে যখন যাওয়া হল তখন সেই বাগানে আগাছার বন। গবাদি পশুদের নন্দনকানন। সেই বাড়ির বাসিন্দারা সেই ছোট্ট শহরের স্মৃতি বুকে জমিয়ে রেখে বড় শহরে পাড়ি দিয়েছিল অনেকবছর আগে – আরও বড় হওয়ার তাগিদে। তারা বড় হয়েও শিকড় জমিয়ে রাখল সেই  ১০৭/২ তেই। আরও বড় বাগান, আরও বড় বপুর ১১১/১ তাদের মন জয় করতে পারেনি, পারবেও না কোনদিন। তবে ১১১/১ রেখে দেবে তাদের বড় হবার স্বপ্নদের, আশাদের, আকাঙ্খাদের।

পৌষ – পার্ব্বণের পালা

খুব ছোটবেলায় মনে আছে চুষি বা চষি পিঠে খুব ভাল লাগত খেতে। আমাদের দোতলার কোয়ার্টারের কাকিমা বানিয়ে খাওয়াতেন। আসলে তখন নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য সবার রান্না খেতে বেশি ভাল লাগত, বুঝতে পারতাম না কেন অন্য সবাই আমার মায়ের রান্নার সুখ্যাতি করত। বাবা অবিশ্যি মজা করে বলতেন, “ভাত রোচে না, রোচে ‘ম’, চিড়ে রোচে ‘প’ ‘প'” অর্থাৎ নিজের বাড়ির দুধ পুলি, সেদ্ধ পুলি – এসব ভাল জিনিস ভাল লাগছে না, উনি যাচ্ছেন ‘চষি পিঠে’ খেতে!!

যারা ‘চষি পিঠে’ কোনদিনও খাওনি, তাদের বলি ‘চষি পিঠে’ হল চালের গুঁড়ি গরম জলে মেখে, প্রদীপের সলতে পাকানোর মত লেই পাকিয়ে দুধে ফোটানো। না আছে নারকোলের ব্যবহার, না আছে ক্ষীর করার ঝঞ্ঝাট। খেতে দুধ পুলি বা সেদ্ধ পুলির তুলনায় একেবারেই নস্যি।

আরও মনে পড়ে, বাড়িতে প্রায় তিনদিন ধরে পিঠে খাওয়া হত। একদিন গরম গরম সেদ্ধ পিঠে পয়রা গুড় দিয়ে, সাথে মুগ সামালি, পাটিসাপ্টা, পরের দিন গোকুল পিঠে ও রস বড়া, আর তার পরের দিন আমাদের রাঙালু খাওয়ানোর জন্য রাঙালুর পিঠে ও পায়েস, সরু চাকলি ও ‘মৌ-ঝোলানি গুড়’। নারকোল নিয়ে আসা হত সু্দূর চব্বিশ পরগণার দাদুর বাড়ি অথবা মাসিদের বাড়ি থেকে, তখন দুর্গাপুরে নারকোল গাছ পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল আর বাজারে নারকোল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল। গুড় অবশ্য বাবা কোথা থেকে আনতেন, উনিই জানতেন, তবে সেই গুড় নানা ভাবে বহুদিন খাওয়া হত। এমন ভাবেই খাওয়া হত যাতে অনেকদিন পর্য্যন্ত খাওয়া যেত। প্রথম দিকে পয়রা গুড় যাকে জলীয় অবস্থার নলেন গুড় বলা হয়, সেটা সেদ্ধ পিঠে দিয়ে খাওয়া হত, সেই গুড়ই বাবা পরের দিকে জল দিয়ে ফুটিয়ে ফুটিয়ে খাওয়াতেন ‘মৌ-ঝোলানি’ গুড় বলে চালিয়ে। তখন এই কাণ্ড-কারখানায় হাসতাম, এখন বুঝতে পারি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সখ ও সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটানো হত এই কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। বাবা হয়ত নিজের ছোটবেলায় যা পাননি, পারেননি,  সেটাই পেতে চাইতেন, পারতে চাইতেন।

বাবার এই পৌষ-সঙ্ক্রান্তি নিয়ে ছেলেমানুষিটাকে যোগ্য সঙ্গত করতেন আমার মা। ওপর ওপর রাগ দেখালেও, বাবা যা যা পিঠে খেতে চাইতেন, তাই  তৈরি করে খাওয়াতেন উনি। বাবা আসকে পিঠে খাওয়ারও ফরমায়েশ করতেন মাঝে মধ্যে, কিন্তু বাড়িতে মাটির সরা না থাকার দরুন মা ইডলি বানিয়ে খাওয়াতেন, মনে আছে। বাবার এই আসকে পিঠে খাওয়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে আমরা বাবার অনুপস্থিতিতে কোনসময় হেসে উঠলে মা বলতেন বাবার ছোটবেলার পিঠে খেতে না পাওয়ার কাহিনী। অভাবের সংসারে তখন এই বচ্ছরকার দিনে ঠাকুমা আসকে পিঠেই তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন, গুড়-নারকোল ছিল সত্যি সত্যি মহার্ঘ্য। তাই জন্যই হয়ত বাবা, সঙ্ক্রান্তির দিনে উচ্চস্তরের পিঠেদের সাথে নিজের ছোটবেলার সেই যত্ন নিয়ে স্বল্পাড়ম্বরে গড়া আসকে পিঠেকেও চেখে দেখতে চাইতেন। সেই মাটির বাড়িতে বেড়ে ওঠার সাধারণ দুঃখ দুর্দশার দিনগুলোকে তুলনামূলক সচ্ছলতার দিনগুলোর সাথে একাসনে বসাতে চাইতেন, হয়ত বা।

সেই বেড়ে ওঠার দিনগুলোয়, কেন জানিনা, এই সম্বৎসরের পিঠে – উৎসব আমার কোনমতেই ভাল লাগত না। মানুষ বোধহয় সহজে যা পায়, তাকেই হেলাফেলা করে। আমারও ছিল তাই অবস্থা। বাংলার পৌষ-পার্ব্বণের অভাব প্রথম বোধ করতে শুরু করি যখন চাকরিসুত্রে ঝাড়খণ্ডে থাকতে শুরু করি। মনে আছে, সেবার, যখন পৌষ-সঙ্ক্রান্তির পর কোন এক দীর্ঘ ছুটিতে কলকাতায় এসেছিলাম, মাকে বলেছিলাম পিঠে করে খাওয়াতে। পরম মমতায় স্পর্শ করেছিলাম উষ্ণ সেদ্ধ পিঠেগুলোকে, খেতে খেতে এক লহমায় যেন পৌঁছে গেছিলাম দুর্গাপুরের কোন এক পৌষের সন্ধেতে।

না ফেরার দেশে পারি দেওয়ার আগেও মা খাইয়েছিলেন রাঙালুর ভাজা পুলির পায়েস ও নতুন গুড়ের পায়েস। পিঠে গড়ার পাঠও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, নিতান্ত আলসেমি ও স্বল্প ধৈর্য্যের জন্য আমি কোনদিনও শিখে নেবার চেষ্টাই করিনি। মন ভেবেছিল, মা তো আছেই, আর শেখার কি দরকার? তখন যদি মন জানত যে মায়ের যাবার সময় হয়ে গেছে, তাহলে হয়ত শিখে নিতাম, নিশ্চই শিখে নিতাম।